Daily Gazipur Online

আজ গাজীপুর মুক্ত দিবস

ডেইলি গাজীপুর প্রতিবেদক: আজ ১৫ ডিসেম্বর গাজীপুর মুক্ত দিবস। দিবসটি উপলক্ষে জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
গাজীপুর মুক্ত হয়েছিলো ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাতে। এর আগে ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর দু’দিন পাক হানাদার বাহিনীর সাথে তুমুল যুদ্ধ হয়েছিলো গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায়।
দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন জেলার নানা স্থানে বিজয় মেলার আয়োজন করেছে।
আজ গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে সকাল ১০টায় বঙ্গতাজ অডিটরিয়ামে জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
এছাড়া, আজ সকাল ১১টায় টঙ্গী প্রেসক্লাবে গাজীপুর পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ ও গাজীপুর সাংবাদিক ইউনিয়ন যৌথভাবে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।
সাবেক এমপি ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কাজী মোজাম্মেল হক বলেন, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের আগেই ১৯৭১ সালে ১৯ মার্চ গাজীপুরের সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধসহ ৫, ১৫, ও ১৭ মার্চের মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনার প্রাক্কালে মুক্তিযুদ্ধে গাজীপুরের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল।
পাকিস্তানী হানাদারের দখল থেকে ১৫ ডিসেম্বর গাজীপুর মুক্ত হয় । ইতিহাস ঐতিহ্যে ভরপুর গাজীপুর মুক্ত হয়েছিলো ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাতে। এর আগে ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর দুই দিন পাক হানাদার বাহিনীর সাথে তুমুল যুদ্ধ হয়েছিলো গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায়। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের আগেই ১৯৭১ সালে ১৯ মার্চ গাজীপুরের সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে গাজীপুরের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গৌরবোজ্জল। ১০ ও১১ ডিসেম্বর গ্রুপ কমান্ডার মোঃ আব্দুল গণি মোল্লার নেতৃত্বে পূবাইলে পাকহানাদারদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধ হয়েছিল। এতে ১০ জন পাকসেনা নিহত ও ৩ জন বীর মুক্তি যোদ্ধা শহীদ হন। ১৩ ডিসেম্বর ব্রাহ্মনবাড়িয়া, কুমিল্লা এবং নরসিংদী হতে মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট পরাজিত পাকবাহিনী ট্রেনে পূবাইল পৌঁঁছলে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের শিকার হয় । ১৪ ডিসেম্বর বিকেলে হায়দরাবাদ গ্রামে প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হয়েছিল মিত্র বাহিনীর সাখে পাক হানাদার বাহিনীর।
১৪ ডিসেম্বর জয়দেবপুর রাজবাড়ীতে অবস্থানরত পাক হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে জয়দেবপুরকে মুক্ত করার লক্ষ্যে মোঃ শহীদুল্লাহ বাচ্চু, প্রয়াত শহীদুল ইসলাম পাঠান, ভুলু ও কাজী আলিম উদ্দিন বুদ্দিন এর নেতৃত্বে অভিযান পরিচালিত হয়। ভুলুর গ্রুপে খোকনও অংশ নেয় । এক পর্যায়ে খোকন বর্তমান কেবির মার্কেটের পিছনে অবস্থানরত অবস্থায় তার গ্রুপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । ১৬ই ডিসেম্বর জয়দেবপুর ফুড গোডাউনের একটি কবরে বদিউজ্জামান ভূইঁয়া ওরফে খোকনের লাশ পাওয়া যায় ।
১৪-১৫ ডিসেম্বর জয়দেবপুর রেল ষ্টেশনের নিকট গোলাগুলির সময় কানাইয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা বদরুজ্জামান খোকন শহীদ হন। ১৫ ডিসেম্বর সকালে জয়দেবপুরসহ আশেপাশের এলাকা দখলদার মুক্ত হয়। তবে ছয়দানায় দেশের সর্ববৃহৎ এবং সর্বশেষ যুদ্ধ শুরু হয় যা ১৬ ডিসেম্বর সকাল পর্যন্ত চলে যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর সকলেই নিহত হয়।
গাজীপুরের জয়দেবপুরে ভাওয়াল রাজ প্রাসাদে স্থাপন করা হয় তৎকালীন পাকিন্তানের ২য় ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সদর দপ্তর । জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে গাজীপুরে মোঃ শামসুল হকের তত্ত্বাবধানে মোঃ হাবিব উল্যাহ এবং আ, ক, ম, মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে ডাঃ সাঈদ ভূঁইয়া, আবদুল বারিক মিয়া, মোঃ হয়রত আলী, শ্রমিক নেতা মোতালেব , মোঃ শহীদল্লাহ বাচ্চু , মোঃ নুরুল ইসলাম (ভাওয়াল রতœ) প্রমুখ স্বাধীনতার আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যান ।
মরহুম মোঃ হাবিবউল্লাহ ও আ, ক, ম মোজাম্মেল হকের ব্যবহৃত রানী বিলাস মনি উচ্চ বিদ্যালয়ের হোস্টেলের কক্ষটি ছিল সংগ্রামের কেন্দ্র বিন্দু। থানা পশু চিকিৎসক ডাঃ আহমেদ ফজলুর রহমানের বাসভবনে ২রা মার্চ সন্ধ্যায় আন্দোলনের রূপরেখা প্রণয়ন এবং জয়দেবপুর মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। সংগ্রাম পরিষদের হাই কমান্ডে ছিলেন, মরহুম মোঃ হাবিবউল্ল্যাহ, প্রয়াত ডাঃ মনীন্দ্রনাথ গোম্বামী , মরহুম এম.এ মোতালিব, ১৯ মার্চের সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের আহবায়ক বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক, কোষাধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম খান। সদস্য নির্বাচিত হন মোঃ নুরুল ইসলাম ভাওয়ালরতœ , মোঃ শহীদুল্যাহ বাচ্চু, শেখ মোঃ আবুল হোসেন, মোঃ আঃ ছাত্তার মিয়া, শহীদুল ইসলাম পাঠান জিন্নাহ , অধ্যাপক আয়েশ উদ্দিন ও মোঃ হারুন-অর-রশীদ।
১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে জকী স্মৃতি প্রাইমারী স্কুলের সামনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক সভা আহবান করা হয়। উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন জয়দেবপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ডাঃ সাঈদ বক্স ভূইঁয়া । ‘‘বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর ’’ এ শ্লোগান দিয়ে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এ সময় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জনাব মোঃ শহীদল্লাহ বাচ্চু, হারুনুর রশীদ , কাজী আলিম উদ্দিন বুদ্দিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন ।
৫ মার্চ টংগীস্থ মেঘনা টেক্সটাইল মিলের শ্রমিক জনতার সাথে পাক হানাদারদের সাথে সম্মুখ সংঘর্ষে চারজন শাহাদাত বরণ করেন। তাদের মধ্যে মোতালেব, রইছ উদ্দিন, ইস্রাফিল অন্যতম ।
১৯ মার্চ, ১৯৭১ দিনটি ছিল শুক্রবার ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে এই ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করতে ঢাকা থেকে জয়দেবপুর এসেছিলেন । কিন্তু জয়দেবপুরবাসীর প্রবল প্রতিরোধে এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, যা ছিল পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম । ১৯ মার্চ মূলত: জয়দেবপুর মুক্তিসংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাহসী ভূমিকার কারণে জনতা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে । পূর্বেই জানা গিয়েছিল ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব তার দলবল নিয়ে জয়দেবপুর রাজবাড়ী ক্যান্টনমেন্ট আসছে বাঙ্গালী সৈন্যদের নিরস্ত্র করার উদ্দেশ্যে । খবর পেয়ে বীর জনতার সাথে জয়দেবপুরের শিমূলতলীস্থ মেশিনটুলস এবং সমরাস্ত্র কারখানা প্রভৃতি স্থান হতে এম.এ মোতালেব ও শহীদল্ল্যাহ বাচ্চুর নেতৃত্বে শ্রমিকরা লাঠি মিছিল নিয়ে চলে আসে । ১৯ মার্চ শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর পাচঁটি চাইনীজ রাইফেলসহ পাকসেনারা রেশন নেয়ার জন্য রাজবাড়ী যাওয়ার পথে জয়দেবপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের নিকট পৌঁছলে জনতা অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়। এ সময় আ.ক.ম মোজাম্মেল হক, হাবিবল্লাহ, মনীন্দ্র গোম্বামী, এম.এ মোতালেব প্রমুখের জ্বালাময়ী বক্তৃতায় জনগণ আরও পাক বাহিনী বিরোধী হয়ে উঠে এবং জয়দেবপুর রেল ক্রসিংয়ে কাঠের গুড়ি ও রেলওয়ের ওয়াগন (মালগাড়ী) ফেলে ব্যারিকেড স্থাপন করে । ঢাকা ফেরার পথে জাহানজেব ব্যারিকেড সরানোর জন্য জনতার উপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিলে বাঙ্গালী সৈন্যরা অপারগতা প্রকাশ করলেও পাক সৈন্যরা গুলি বর্ষণ করে। পাক বাহিনীর ছোঁড়া গুলিতে নেয়ামত ও মনু খলিফা শাহাদাতবরণ করে ও বহু লোক হতাহত হয় ।
জয়দেবপুর চৌরাস্তায় পাক বাহিনীর ঢাকা যাবার পথ রুদ্ধ করার জন্য জননেতা আঃ ছাত্তার মিয়া, অধ্যাপক আঃ বারী, সফি উদ্দিন, ইমান উদ্দিন , এ্যাড. হযরত আলী, আসকর আলী সরকার, হুরমত, সাংবাদিক এম.এ বারীসহ শত শত জনতা ব্যারিকেড স্থাপন করে। এক পর্যায়ে জয়দেবপুর হতে ঢাকা অগ্রসরমান পাক বাহিনী চৌরাস্তায় পৌঁছলে মানুষ শ্লোগান ও প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এ সময় জনতার মধ্যে হতে ফুটবল খেলোয়াড় হুরমত এক পাকসেনাকে ঝাপঁটে ধরে তাকে পরাস্ত করে হাতের রাইফেল ছিনিয়ে নেয় । তখন অপর পাশ থেকে পাক বাহিনীর ছোঁড়া গুলিতে ঘটনাস্থলেই শাহাদাতবরণ করে ফুটবলার বীর হুরমত । গুলিতে আহত কানু মিয়া হাসপাতালে মারা যায় । একই সময়ে ১৯শে মার্চ টংগীতে গড়ে উঠে তীব্র গণ আন্দোলন । এই ১৯ মার্চ এর প্রতিরোধ আন্দোলনের আগে ৫ মার্চ , ১৫ মার্চ, এবং ১৭ মার্চ টংগীতে নেতৃত্ব দেন কাজী মোজাম্মেল হক, হাকিম মাস্টার, আহসান উল্লাহ মাস্টার , হাসান উদ্দিন সরকার, সবদর আলী মাস্টার , হাফিজ মাস্টার , আঃ মান্নান পাঠান, আজমতউল্ল্যাহ খান, গাজী আঃ মজিদ, ডাঃ আঃ রশিদ প্রমুখ। বীর জনতা টংগীর রাস্তায় রাস্তায় কাঠের গুড়ি ফেলে, টায়ার ফেলে, টায়ার পুড়িয়ে, মিছিল করে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন অব্যাহত রাখে ।
২১ মার্চ কার্ফু উঠিয়ে নেয়ার পর ২৩ মার্চ বিকেলে জয়দেবপুরে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকাবাসীদের উপর পাকহানাদার বাহিনীর হামলার পর ২৮ ও ২৯ মার্চ চলে রাজবাড়ী ক্যান্টনমেন্ট সিপাহী বিদ্রোহ। লুন্ঠণ করা হয় গাজীপুর অস্ত্রাগার । নিহত হয় ৩০ জন পাকিস্তানি সৈন্য। ৩১ মার্চ শ্রীপুরে শুরু হয় সশস্ত্র সংগ্রাম। শ্রীপুরে মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর মাজুখান পুলে পাঞ্জাবী সৈন্য ও রাজাকারদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের এক ভয়াবহ বন্দুক ও মাইন বিষ্ফোরণও ঘটানো হয় । ১৪ অক্টোবর রাতে ধীরাশ্রমে মুক্তিযোদ্ধারা রেললাইন উপড়ে ফেলে এবং ভোররাতে জয়দেবপুর স্টেশনের দক্ষিণ সিগন্যাল সংলগ্ন সেতু মাইন বিষ্ফোরণে উড়িয়ে দিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় ।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গাজীপুরে বেশ কয়েকটি গণহত্যা সংঘটিত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কালিগঞ্জ কটনমিল, জয়দেবপুর গণহত্যা, ইছরকান্দি গণহত্যা, শ্রীপুর গণহত্যা, শ্রীপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ক্যাম্পাস গণহত্যা, সমরাস্ত্র কারখানায় নির্যাতন ও গণহত্যা এবং বাড়িয়া গণহত্যা। মুক্তিযুদ্ধে গাজীপুরে শহীদ হন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন আবদুল বাতেন আকন্দ, আব্দুস সামাদ, মোঃ বাচ্ছু মিয়া, সুনীল, বাদশা, মাজেদ মিয়া, আবুল হোসেন প্রমুখ ।
শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধারা হলেন, ১৯শে মার্চ, ১৯৭১ প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর গুলিতে নিহত হন শহীদ হুরমত, শহীদ মনু মিয়া খলিফা, শহীদ কানু মিয়া ও শহীদ নেয়ামত। এছাড়া ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সময়ে শহীদ হন অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা।