পাচার হতে যাওয়া ২৩ নারী উদ্ধার, গ্রেপ্তার ১১

0
171
728×90 Banner

ডেইলি গাজীপুর প্রতিবেদক : র‌্যাবের অভিযানে রাজধানীর মিরপুর, উত্তরা, তেজগাঁও এবং চুয়াডাঙ্গা থেকে বিদেশে পাচার হতে যাওয়া ২৩ জন নারীকে উদ্ধার করা হয়েছে। এসময় দুটি পাচার সিন্ডিকেটের মূলহোতাসহ ১১ জন গ্রেপ্তার করা হয়।
র‌্যাব জানায়, গত মে মাসে পার্শ্ববর্তী দেশে বাংলাদেশের এক তরুণীর পৈশাচিক নির্যাতনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রেক্ষিতে র‌্যাব পার্শ্ববর্তী দেশে মানব পাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা বস রাফিসহ চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। এছাড়াও একজন মহিয়সী ‘মা’ জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে নিজে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েকে পাচারকারীদের নিকট হতে উদ্ধারের ঘটনা প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হলে পাচারকারী চক্রের কাল্লু-সোহাগ ওরফে কাল্লু-নাগিন সোহাগ ওরফে মামা-ভাগিনা ওরফে কালা-নাগিন সিন্ডিকেটের ৩ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এ ঘটনা নিয়ে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণার ফলে বেশ কয়েকজন মানব পাচারের শিকার ভিকটিম প্রতিকারের আশায় র‌্যাবের নিকট অভিযোগ করে। প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে র‌্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে ও গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে।
র‌্যাব-৪ এর একাধিক আভিযানিক দল গতকাল শুক্রবার (২৯ অক্টোবর) রাতে অভিযান চালিয়ে রাজধানীর মিরপুর, উত্তরা ও তেজগাঁও হতে ২২ জন নারী ও চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবনগর এলাকা হতে ১ জন নারীসহ সর্বমোট ২৩ জন বিদেশ পাচার হতে যাওয়া নারী ভিকটিমদের উদ্ধার করে। গ্রেপ্তার করা হয় মানব পাচার চক্রের ২টি চক্র। তন্মধ্যে ঢাকার মোহাম্মদপুর, খিলক্ষেত ও চুয়াডাঙ্গা হতে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার চক্রের মূলহোতা মো. কামরুল ইসলাম ওরফে জলিল ওরফে ডিজে কামরুল ওরফে ড্যান্স কামরুল (৩৭) এবং তার চক্রের সদস্য মো. রিপন মোল্লা (২২), মো. আসাদুজ্জামান সেলিম (৪০), মো. নাইমুর রহমান ওরফে শামীম (২৫), এবং বনানী, পল্লবী, তেজগাঁও ও উত্তরা হতে মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচার চক্রের মূলহোতা মো. নুর-নবী ভুইয়া রানা (৪৪) এবং তার চক্রের সদস্য মো. আবুল বাশার (৫২), মো. আল ইমরান (৪১), মনিরুজ্জামান (৩৫), মো. শহিদ সিকদার (৫৪), প্রমোদ চন্দ্র দাস (৬২), টোকন (৪৫)-দেরকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এসময় র‌্যাব-৪ এর অভিযানে ৫৩টি পাসপোর্ট, ২০টি মোবাইল, ৮ বোতল বিদেশী মদ, ২৩ ক্যান বিয়ার, ২টি মোটর সাইকেল, ১টি ল্যাপটপ, ১ সেট কম্পিউটার, ৯১,০৪০ টাকাসহ মানব পাচার সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র জব্দ করা হয়।
আজ শনিবার (৩০ অক্টোবর) র‌্যাব-৪ এর আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) এর লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, এ ঘটনার প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, পার্শ্ববর্তী দেশে মানব পাচারকারী চক্রের মূলহোতা গ্রেপ্তারকৃত মো. কামরুল ইসলাম ওরফে জলিল ওরফে ডিজে কামরুল ওরফে ড্যান্স কামরুল । এই চক্রের সদস্য সংখ্যা প্রায় ১৫-২০ জন। ২০১৯ সাল হতে এই চক্রটি সক্রিয়ভাবে মানব পাচারের মতো অপরাধ করে আসছে। চক্রটি দেশের বিভিন্ন জেলা হতে কমবয়সী মেয়েদের প্রতারণামূলক ফাঁদে ফেলে এবং প্রলোভন দেখিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে। প্রথমে চক্রটি ভিকটিমদের নাচ/ডেন্স শেখানোর নামে প্রত্যন্ত অঞ্চলের থেকে সুন্দরী মেয়েদের ঢাকায় নিয়ে আসত। তাদেরকে বেপোয়ারা জীবন যাপনে অভ্যস্ত করে ফেলা হত। পরবর্তীতে তাদের পার্শ্ববর্তী দেশে বিভিন্ন চাকুরীর কথা বলে প্রলুব্ধ করে পাচার করত। এই ভাবে এই চক্রটি গত ২/৩ বছরে প্রায় শতাধিক মেয়েকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে। ভিকটিমদের পার্শ্ববর্তী দেশে মার্কেট, সুপারশপ, বিউটি পার্লারসহ লোভনীয় চাকুরীর প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করত। মূলত পার্শ্ববর্তী দেশে অমানবিক এবং অনৈতিক কাজ করানোর উদ্দেশ্যে তাদের পাচার করা হতো। এই চক্রটি রাজাধানী ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় সক্রিয় রয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতরা আরো জানায়, ভিকটিমদেরকে সীমান্তের অরক্ষিত এলাকা দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে। এই চক্রের সাথে পাশ্ববর্তী দেশের সিন্ডিকেটের যোগসাজশ রয়েছে। পাশ্ববর্তী দেশের চক্রের সদস্যরা ভিকটিমদের ভূয়া কাগজপত্র তৈরি করে। অতঃপর বিপুল অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন শহরে/প্রদেশে অনৈতিক কাজ করানোর উদ্দেশ্যে বিক্রয় করে দিত। এরপর থেকে ভিকটিমদের আর কোনও সন্ধান পাওয়া যায় না। এই চক্রের মূলহোতা গ্রেপ্তারকৃত ডিজে কামরুল।
মিডিয়া উইংয়ের এ পরিচালক আরো বলেন, গ্রেপ্তারকৃত মো. কামরুল ইসলাম ২০০১ সালে কুমিল্লা হতে ঢাকায় পাড়ি জমায়। প্রাথমিক পর্যায়ে সে বাড্ডা এলাকায় রিক্সা চালক হিসেবে জীবিকা শুরু করে। কিছুদিন পর সে একটি কোম্পানির ডেলিভারি ভ্যান চালক হিসেবে কাজ নেয়। অতঃপর সে ড্যান্স গ্রুপের সাথে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে সে হাতিরঝিল এলাকায় ‘ডিজে কামরুল ড্যান্স কিংডম’ নামে একটি ড্যান্স ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে। উক্ত ড্যান্স ক্লাবের মাধ্যমে সে বিভিন্ন উঠতি বয়সী মেয়েদের বিনোদন জগতে প্রবেশের নামে প্রলুব্ধ করত। একপর্যয়ে তাদের উচ্চ বেতনে চাকরীর প্রলোভন দেখিয়ে প্রলুব্ধ করে পাশ্ববর্তী দেশে পাচার করত। গ্রেপ্তারকৃত কামরুল ইসলাম বেশ কয়েকবার পার্শ্ববর্তী দেশে ভ্রমণ করে। পার্শ্ববর্তী দেশের নারী পাচারকারী চক্রের সাথে সখ্য গড়ে উঠে। ২০১৯ সালে এপ্রিল মাসে সে তার ড্যান্স ক্লাবের ১ নারীকে পার্শ্ববর্তী দেশের বিউটি পার্লারে অধিক বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করে। উক্ত ঘটনায় ভিকটিম-এর বোন তার বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করলে, সে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাড্ডা থানা পুলিশ কর্তৃক আটক হয়।
তিনি বলেন, উক্ত মামলায় ৩ মাস কারা অন্তরীণ ছিল। পরবর্তীতে জামিনে বের হয় এবং পুনরায় তারা নারী পাচার কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। চক্রটি প্রলোভনের শিকার নারীদের পরিকল্পনা মোতাবেক বিভিন্ন সীমান্তবর্তী জেলায় অবস্থিত সেইফ হাউজে অবস্থান করাত। পরবর্তীতে সেইফ হাউজে থাকা অবস্থায় তাদের নিকট হতে মোবাইল নিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হত। এরপর সুবিধাজনক সময়ে এই চক্রের সদস্যরা নারী ভিকটিমদের অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে। এই চক্রের গ্রেপ্তারকৃত রিপন, সেলিম এবং শামীম নারী পাচারের অবৈধ কাজে মূলহোতাকে সহায়তা প্রদান করত বলে স্বীকার করে।


কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তারকৃত মো. রিপন মোল্লা ডেলিভারী ম্যান হিসেবে কাজ করে। সে মূলহোতার পক্ষে মানবপাচারে পার্শ্ববর্তী দেশের দালালের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখত। সে পাচার যোগ্য নারীদের ছবি পার্শ্ববর্তী দালালের কাছে প্রেরণ করে। পার্শ্ববর্তী দেশের দালালদের ওকে রিপোর্ট অনুযায়ী পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করা হত। গ্রেপ্তারকৃত মো. আসাদুজ্জামান সেলিম বর্তমানে উত্তরা এলাকায় ব্যবসা করে এবং পাশাপাশি মূলহোতা কামরুলের মানব পাচারসহ অন্যান্য অনৈতিক কাজে সহযোগিতা করত। গ্রেপ্তারকৃত মো. নাইমুর রহমান ওরফে শামীম সীমান্ত এলাকায় সেইফ হাউজ পরিচালনা, অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপার ও পার্শ্ববর্তী দেশের দালালের কাছে ভিকটিমদের হস্তান্তর করে।
র‌্যাব জানায়, পাচার চক্রের সদস্যদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, এটি মধ্যপ্রাচ্যে মানব পাচারকারী একটি চক্র। চক্রে দেশে ১০-১২ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছে। ৫/৭ বছর যাবত এই চক্রটি সক্রিয়ভাবে নারী ও পুরুষ মানব পাচার করে আসছে। হাউজকিপিং, নার্স, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি পেশায় নারী কর্মীদের বিনা অর্থে প্রেরণের প্রলোভন দেখিয়ে উঠতি বয়সী তরুণী ও মধ্য বয়স্ক নারীদের প্রলুব্ধ করত এই চক্রটি। মূলত বিদেশে পাচারের মাধ্যমে ভিকটিমদের বিক্রি করে দেয়া হত। এ পর্যন্ত চক্রটি ইতোমধ্যে ৩০-৩৫ জন নারীকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে। পাচারকারীরা ঢাকায় কয়েকটি সেইফ হাউজ পরিচালনা করে। বেশকয়েকদিন উক্ত সেইফ হাউজে ভিকটিমদের আটকে রেখে পরবর্তীতে মধ্যপ্রাচ্যে পাচার করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যে ভিকটিমদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বিনিময় বিক্রি করা হত। চক্রটি রাজাধানী ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় সক্রিয় রয়েছে। চক্রটি কয়েকটি ধাপে বিভিন্ন দেশে নারীদের পাচার করে আসছে। প্রথমত তারা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা হতে উঠতি বয়সী এবং আর্থিক ভাবে অস্বচ্ছল যুবক-যুবতী ও মধ্যবয়স্ক নারীদের টার্গেট করে তাদের সাথে সখ্য গড়ে তোলে এবং বিদেশে বিভিন্ন লোভনীয় চাকরীর প্রলোভন দেখায়। এতে তারা রাজি হলে প্রথমত তাদের ঢাকায় অবস্থিত সাজানো অফিসে এনে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে এবং বিদেশে যাওয়ার জন্য স্বল্পকালীন ভুয়া প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। এ সময় কোনো নারী বিদেশে যেতে অনীহা প্রকাশ করে পাসপোর্ট ফেরত চাইলে তাদের নিকট দেড় হতে দুই লক্ষ টাকা দাবী করত। এই মধ্যপ্রাচ্যে মানব পাচারকারী চক্রের মূলহোতা গ্রেপ্তারকৃত মো. নুর-নবী ভুইয়া রানা।
র‌্যাবের তথ্য মতে, গ্রেপ্তারকৃত মো. নুর-নবী ভুইয়া রানা লক্ষ্মীরের স্থানীয় একটি কলেজ হতে ১৯৯৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৯৬ সালে সে ঢাকায় এসে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরী দিয়ে কর্মজীবন শুরু করে। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সাল হতে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ওমানে প্রবাসী হিসেবে কাজ করে। ওমানে থাকা অবস্থায় মানব পাচারকারী একটি চক্রের সাথে তার পরিচয় হয় এবং তখন থেকেই মানব পাচার কার্যক্রমের সাথে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ২০২০ সালে ওমান থেকে দেশে ফিরে মানবপাচারের সাথে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়ে। গ্রেপ্তারকৃত আবুল বাশার, ইমরান, মনিরুজ্জামান, শহীদ এবং প্রোমদ এই চক্রের সক্রীয় সদস্য এবং নুর নবী ভুঁইয়ার নেতৃত্বে মানব পাচারের এই অবৈধ কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে।
খন্দকার আল মঈন বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশে মানব পাচার চক্রের মূলহোতা ডিজে কামরুলের নামে ডিএমপি, বাড্ডা থানায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে ১টি মামলা রয়েছে। এছাড়া অপর চক্রের সদস্য মনিরুজ্জামান এর নামে ডিএমপি, সবুজবাগ থানায় বাংলাদেশ পাসপোর্ট আইনে, প্রমোদ এর নামে ডিএমপি, পল্টন থানায় প্রতারণার এবং টোকন এর নামে যশোর জেলার অভয়নগর থানায় প্রতারণা ও জালিয়াতির ১টি করে মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানান র‌্যাবের এই কর্তকর্তা।

Print Friendly, PDF & Email
728×90 Banner

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here