আমার ছোট্ট বেলার একটি হাস্যকর স্বপ্ন

0
165
728×90 Banner

এড. এম এ মজিদ : স্বপ্নটি ১৯৬৫ সালের। তখন আমি দিনাজপুর জিলা স্কুলের ৮ম শ্রেণির ছাত্র। আমার বাবা কবি নূরুল আমিন যে কোনো সময় যে কোনো বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে যে কোনো কবিতা লিখতে পারতেন বলেই তিনি “স্বভাব কবি” হিসেবে খুবই সুপরিচিত ছিলেন। তিনি ১৯৬৬ সালে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সমাজসেবক ও বিদ্যোৎসাহী হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার, সার্টিফিকেট, মেডেল ও অর্থ পেয়েছিলেন। এদিকে আমার সদ্য অগ্রজ মতিউর রহমান কবি ও ছড়াকার হিসেবে দিনাজপুরের অনেকেই তাকে একনামে চিনেন এবং জানেন। তখনই তার কবিতা দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকাসহ অনেক জাতীয় পত্রপত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হতো। এমনকি সেসময় ঢাকা রেডিও সেন্টার থেকেও স্বপাঠিত কবিতা এবং ছাড়াও প্রচারিত হয়েছিল। এছাড়াও আমার অন্যান্য ভাই ও বোনেরাও কবিতা, ছড়া ও সাহিত্যে বেশ পারদর্শী ছিলেন। ফলে স্বরচিত কবিতা, ছড়া ও প্রবন্ধ পাঠে প্রথম পুরস্কারটা আমাদের বাড়িতেই আনতেন আমাদের সকল ভাই ও বোনেরা। কিন্তু আমি একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলাম। আমি কোরআন তেলওয়াত ও উপস্থিত বক্তৃতায় পুরস্কার আনলেও কবিতা ও ছড়ায় কোনো পুরস্কার পাওয়া তো দূরের কথা – আমি কবিতা ও ছড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহনই করতে পারতাম না। এজন্য আমার মনে দূঃখ ও ক্ষোভ ছিল প্রচুর। আমি মনে মনে কঠোর সিদ্ধান্ত নিলাম, যে করেই হোক আমাকে কবি ও ছড়াকার হতেই হবে। প্রতিদিনই আমি দু’লাইন চার লাইন করে কবিতা লিখতে পারলেও এর বেশি লিখতে পারতাম না। কিন্তু আমি কবিতা লিখার হাল ছাড়লাম না।
একদিন রাতে কবিতা লিখতে লিখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি তা আমি নিজেও জানি না। রাতে সুন্দর একটি কবিতা লিখে ফেল্লাম। কবিতাটি এতই সুন্দর হয়েছে যে, সকলকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য আমার লেখা সুন্দর কবিতাটি বেশ কয়েকবার পড়ে পড়ে মুখস্থ করে ফেললাম। অনেক ভোরে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই আমি আমার অগ্রজ মতিউর রহমানকে জোর করে ঘুম থেকে জাগালাম। মতিউর ভাই তো আমার কথাবার্তা ও ভাবভঙ্গি দেখে আমাকে বললো, বলতো তোর কি হয়েছে? তোকে এত খুশি খুশি লাগছে কেন? আমি বললাম, শুধু তুই কবিতা লিখতে পারিস? আমিও কবিতা লিখতে পারি। আমার কবিতা তোর চাইতেও অনেক বেশি সুন্দর এবং উন্নতমানের। মতিউর ভাই বললেন, তুই তোর উন্নতমানের কবিতা আমাকে শোনা। আমি বেশ ভাব নিয়ে কবিতার একটি লাইন তো দূরের কথা, একটি অক্ষরও বলতে পারছিলাম না। গলা শুকিয়ে গেল। রাতে মার রেখে যাওয়া পিতলের পানির জগ থেকে মগে পানি ঢেলে নিমিষেই গড় গড় করে পুরো এক মগ পানি খেয়ে নিলাম। কিন্তু কবিতার কোনো কিছুই মনে আসছিল না। মতিউর ভাই বললেন, কখন তুই কবিতা লিখেছিস? আমি বললাম মধ্য রাতে। মতিউর ভাই বললেন, তুই তো রাত ৯টার সময়ই পড়ার টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলি। আমি তো তোকে রাতে বিছানায় সোজা ও ঠিকঠাক করে শুইয়ে দিয়েছিলাম। আমি তখন বুঝতে পারলাম, বাস্তবে নয় আমি কবিতা লিখেছি স্বপ্নে এবং আমি কবিতাটি মুখস্থও করেছিলাম স্বপ্নেই – এটি বুঝতে পেরে আমি বেশ লজ্জাই পেলাম। কিন্তু কবিতা লেখার চ্যালেঞ্জ আমি আরো বাড়িয়ে দিলাম। এভাবে আমি প্রতিদিন বাস্তবে কবিতা লিখার চেষ্টা জোরদার করে দিলাম। কিন্তু রাতের স্বপ্নেই কবিতা লিখি আর মুখস্থ করে ফেলি কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতের স্বপ্নে লিখা ও মুখস্থ করা কবিতাগুলো আর বলতেই পারি না।
এবারে আমার মাথায় নতুন বুদ্ধি চলে এলো। স্বপ্নের কবিতাটি যেন ভুলে না যাই সেজন্য খাতায় লিখে রাখার জন্য টেবিলের উপরে খাতা খুলে খাতার ভিতরেই কলম রেখে দিলাম। ঘুমিয়ে পড়ার পরে মধ্যরাতে স্বপ্নে খুব একটা সুন্দর কবিতা লিখে ফেললাম। কবিতাটি এতটাই ছন্দময় এবং উন্নতমানের ছিল যে, আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছিল। আমি ২০/২৫ বার পড়তে পড়তে কবিতাটি শুধু মুখস্থই নয় – ঠোঁটস্হ করে ফেললাম। ইত্যবসরে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম ভেঙ্গে গেলে কি হবে স্বপ্নেই মুখস্থ করা কবিতাটি আমি আমার টেবিলের উপর রাখা খাতাটিতে সুন্দর করে লিখে ফেললাম এবং এক বিশাল স্বস্তি ও প্রশান্তি নিয়ে পুনরায় বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করছিলাম আর ভাবছিলাম, আজ আমার অগ্রজ মতিউর রহমানকে সারপ্রাইজ দিয়ে দেখিয়ে দিব যে, আমি তার চাইতে ভালো কবিতা লিখতে পারি। এরকম ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোর বেলা আমার অগ্রজ মতিউর রহমানকে হাকডাক দিয়ে অনেকটা জোর করেই ঘুম থেকে ডেকে উঠিয়ে বললাম, অন্যান্য রাতের মতো আর ভুল করিনি, গতরাতে স্বপ্নে লিখা কবিতাটি আমি শুধু মুখস্থই করিনি, খাতাতেও হুবহু লিখে রেখেছি। মতিউর ভাই বললেন, এত কথা বলে সময় নষ্ট না করে কবিতাটা আমাকে শোনা। আমি যার-আর-পর-নেই খুশি হয়ে খাতাটা হাতে নিয়ে কবিতা পাঠ করবো, কিন্তু তখনই দেখলাম খাতা ও কলমটা রাতে যেভাবে রেখেছিলাম সেভাবেই আছে অর্থাৎ রাতে স্বপ্ন দেখার পর ঘুম থেকে উঠে টেবিলের উপরে রাখা খাতায় যে কবিতাটি আমি লিখেছিলাম – সেটিও রাতে আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম। মতিউর রহমান ভাইয়ের কাছে আমি আরো একবার ভীষণ লজ্জা পেলাম। মতিউর রহমান ভাই বিশাল হৃদয়ের অধিকারী একজন অনেক বড় মাপের মানুষ। তিনি আমাকে কোনো লজ্জা বা খোটা না দিয়ে বললেন, মন খারাপ করিস না, দেখবি একদিন তোর রাতের দেখা স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়ে তুই শুধু অনেক বড় কবিই হবি না, বরং তুই দেশের অনেক বড় কিছু হয়ে তোর দ্বারা দেশ ও দশ অনেক উপকৃত হবে।
আমার সদ্য অগ্রজ মতিউর রহমানের সেই আশীর্বাদটি যদি আল্লাহ কবুল করতেন তাহলে আমার দ্বারা অনেকেই উপকৃত হলে আমি সেই “সৃষ্টি সুখের উল্লাসের” মতো কতই না আনন্দ পেতাম। কিন্তু হায়! আমার দ্বারা দেশ ও দশের উপকার করা তো দূরের কথা আমি আমার স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানের জন্যও কিছুই করতে পারিনি।


বীর মুক্তিযোদ্ধা লায়ন এড. এম এ মজিদ,
অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং চেয়ারম্যান, জাতীয় সাংবাদিক সোসাইটি ও ওয়ার্ল্ড পীস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস সোসাইটি।

Print Friendly, PDF & Email
728×90 Banner

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here