ভ্যাট অফিস যখন শিল্প বিকাশের অন্তরায়!

0
290
728×90 Banner

ডেইলি গাজীপুর প্রতিবেদক: টঙ্গীতে ঢাকা উত্তর কাস্টমস কর্মকর্তাদের নিপীড়নমূলক কর্মকাÐ ও অত্যাচারে শিল্পোক্ত্যাদের মধ্যে অস্বস্থি ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। ভ্যাট অফিসের ঘুষের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলেই শিল্প মালিকদের উপর অত্যাচারের খড়ক নেমে আসে। বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি শিল্প মালিক এবং সাধারণ ব্যবসায়ীরা কাস্টমস, এক্্রাইজ ও ভ্যাট অফিসের অসৎ কর্মকর্তাদের অত্যাচারে বর্তমানে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। ইতিমধ্যে তাদের কারখানা ঋণগ্রস্ত, রুগ্ন ও দেওলিয়া হয়ে যাচ্ছে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে রুগ্ন শিল্পগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ ব্যহত হচ্ছে এবং কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলেও ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন।
শিল্প মালিকরা জানান, ভ্যাট নিবন্ধিত কারখানা কর্তৃপক্ষকে প্রতিমাসে কাস্টমস, এক্্রাইজ ও ভ্যাট অফিসে নিয়মিত রিটার্ন দাখিল করতে হয়। রিটার্ন দাখিল করতে গেলে নির্ধারিত হারের মাসোহারা ছাড়া ভ্যাট অফিসে রিটার্ন গ্রহণ করা হয় না। যেসব ব্যবসায়ী ঘুষের বিনিময়ে রিটার্ন দাখিল করতে অপারগতা প্রকাশ করেন তাদের বিরুদ্ধে রিটার্ন দাখিল না করার অভিযোগে অনিয়মের মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়। কথিত অনিয়মের এসব মামলায় জবাব দাখিল করতে গেলে ভ্যাট অফিসের মনমত না হলে জবাব গ্রহণ করা হয় না। ভ্যাট অফিসের কর্মকর্তাদের নিজস্ব মতামত ও নির্দেশনা অনুযায়ী জবাব দাখিল করতে বলা হয়। প্রকৃত সত্য ও বাস্তব অবস্থা তুলে ধরে জবাব দাখিল করতে বাধা দেওয়া হয়। মামলার জরিমানা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে তাদের (রাজস্ব কর্মকর্তাদের) ইচ্ছেমত জবাব দাখিল করতে বলা হয়। অনেকে সরল বিশ^াসে রাজস্ব কর্মকর্তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী জবাব দাখিল করার পর জবাব সন্তোসজনক না হওয়ার অজুহাতে তাদের উপর মোটা অংকের জরিমানা আরোপ করা হয়। ভ্যাট অফিসের এমন আদেশের বিরুদ্ধে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে আপিল করতে গেলে সেখানেও একইভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। মামলার জবাব ছাড়াও মূল্য ঘোষণা ও যে কোন চিঠিপত্র জমা দিতে গেলে ভ্যাট অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীরা আগে পালাক্রমে পড়ে দেখেন। তারা সন্তষ্ট হলে পরে টাকার বিনিময়ে পত্র গ্রহণ করেন। অন্যথায় ফেরত দিয়ে দেন। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে এসব অভিযোগ করলে অভিযোগ আমলে না নিয়ে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তার সাথেই আলোচনা করে সমস্যার সমাধানের পরামর্শ দিয়ে ফেরত পাঠানো হয় বলে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন। তারা আরো জানান, ভ্যাট অফিসের মাসোহারার তালিকায় প্রত্যেকটি কোম্পনীর নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে। যে সব কোম্পানী নিয়মিত মাসোহারা দেয় না বা দিতে গড়িমসি করে কাস্টম কর্মকর্তারা দলবল নিয়ে ঐসব কোম্পনীতে গিয়ে হানা দেন। অভিযানকালে তারা মালিককে হুমকি দিয়ে বলেন, তাদের (রাজস্ব কর্মকর্তাদের) গুলি ও গ্রেফতারের ক্ষমতা রয়েছে। এভাবে ভয়বীতি প্রদর্শন করে গ্রেফতার ও কোম্পানী বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেয়া হয়। অভিযানকালে তারা কারখানায় ভাংচুর চালান এবং সমস্ত কাগজপত্র জব্দ করে নিয়ে যান। এমনকি যে সব কাগজপত্র ভ্যাটের সাথে সংশ্লিষ্ট না সেসব কাগজপত্রও জব্দ করে নেয়া হয়। যাতে কোম্পানী ব্যবসা পরিচালনা করতে না পারে এবং যাতে ভ্যাট অফিসের সাথে মাসোহারা ভিত্তিক যোগাযোগ করতে বাধ্য হয়। যোগাযোগ না করলে মিথ্যা, কাল্পনিক, ভিত্তিহীন ও ভূতুরে হিসাব তৈরি করে কথিত কর ফাঁকির মোটা অংকের জরিমানা আরোপ করা হয়। এভাবে তাদের সাথে আলোচনায় বসতে ব্যবসায়ীদের বাধ্য করা হয় এবং জরিমানার টাকা পরিশোধ করতে অথবা তাদেরকে এক তৃতীয়াংশ টাকা দিয়ে সমাধানের প্রস্তাব দেওয়া হয়। তাদের এই প্রস্তাবে রাজি না হলে ভয়াবহ ক্ষতির ফিরিস্তি তুলে ধরে বলা হয়, হয়রানি হবেন, মামলায় টাকা খরচ হবে এবং জরিমানার টাকা ঠিকই পরিশোধ করতে হবে। যদি আপিল করতে যান তাহলে জরিমানার টাকার ১০% আগাম জমা দিয়ে আপিল করতে হবে। অতএব আপিলের ওই ১০% টাকা আমাদেরকে দিয়ে দিলেই সরকারি খাতায় কিছু জমা দিয়ে আমরা আপনাকে অভিযোগ থেকে খলাস দিতে পারি। এভাবে ব্যবসায়ীদেরকে সর্বস্বান্ত করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা উপায়ান্তর না পেয়ে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বা ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন; আবার যাদের টাকা আছে তারা ঘুষ ভিত্তিক সমঝোতায় গিয়ে ব্যবসা চালু রাখছেন।
ভুক্তভোগী একজন ব্যবসায়ী জানান, কাস্টমস কর্মকর্তারা ভ্যাট আইনের ৬২ ধারায় ব্যবসায়ীদেরকে জিম্মি করে রেখেছেন। কথায় কথায় এসব রাজস্ব কর্মকর্তা ৬২ ধারার উল্লেখ করে বলেন, ‘আমরা এই ধারা অনুযায়ী চলি। আমাদের বিরুদ্ধে কোথাও কোন অভিযোগ করা যাবে না। এই আইনটি পড়ে যান, পারলে আমাদের বিরুদ্ধে কিছু কইরেন।’ ভ্যাট অফিস দ্বারা হয়রানি ও আরো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী এসব অভিযোগ করেছেন।
ভুক্তভোগী প্রবাসী তরুন ব্যবসায়ী আমির হোসেন জানান, তিনি প্রবাসে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে কষ্টার্জিত টাকা টঙ্গী বিসিকের একটি কারখানায় বিনিয়োগ করেন। কারখানা কর্তৃপক্ষ প্রতারণা করে তার টাকা আত্মসাত করেন এবং সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও ব্যক্তির নিকট ভীষণভাবে ঋণী হয়ে যান। একপর্যায়ে আদালত কোম্পানীটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে আদালত কোম্পানীর আয় থেকে দায় শোধ করার জন্য দেওলিয়া ঘোষিত রুগ্ন শিল্পটিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য নতুন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাছে দায়িত্ব ন্যাস্ত করেন।
নতুন ব্যবস্থাপনা কতৃপক্ষ সমাজের বঞ্চিত, অশিক্ষিত, শিক্ষিত প্রতিবন্ধীদের কাজে লাগিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। কোম্পানিটি প্লাস্টিক স্যান্ডেলের জুতা উৎপাদন করে। যার বর্তমান মূল্য ২৫ টাকা হতে ৭৫ টাকার মধ্যে। বর্তমান ভ্যাট আইনে দেড়শ টাকার প্লাস্টিক জুতার মূল্য ভ্যাট অব্যাহতিপ্রাপ্ত। তথাপি কাস্টম অফিসে শূন্যহারে রিটার্ন দাখিল করতে গেলে মাসোহারা না দেওয়ার কারণে কোম্পানী কর্তৃপক্ষকে বিভিন্নভাবে নাজেহাল করা হচ্ছে। সর্বশেষ কাস্টম কর্মকর্তারা গত ৬ মার্চ দলবল নিয়ে কোম্পানীতে ভাংচুর, নগদ টাকা পয়সা এবং কোম্পানীর সাথে এমনকি ভ্যাট সংশ্লিস্ট নয় এমন কাগজপত্র ও দলিলাদি জব্দ করে নিয়ে যায়। পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর ফেরত দেওয়ার আশ^াস দেওয়া হলেও এগুলো আজও ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। কাগজপত্র ফেরত চেয়ে উত্তরায় কাস্টম অফিসে কারখানা কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ করলে তাদেরকে চার কোটি টাকার কাল্পনিক হিসাব ধরিয়ে দিয়ে বলা হয়, ‘আপনারা চার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছেন, এতে ৬০ লাখ টাকার ট্যাক্্র ফাঁকির আদেশ হবে। আদেশে সংক্ষুব্ধ হয়ে আপিল করতে গেলে ১০ ভাগ টাকা আগাম জমা দিতে হবে। এতে আপনি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, এখন কি করবেন আপনি সিদ্ধান্ত নেন।’
ব্যবসায়ী আমির হোসেন বলেন, আমি নিয়ম অনুযায়ী কোন ভ্যাট ফাঁকি দিই নাই। বরং আমার পণ্য ভ্যাট অব্যাহতিপ্রাপ্ত থাকা সত্বেও এর সুফল ভোগ করতে পারছি না। উল্টো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। কারণ আমার কোম্পানী দেওয়ালিয়া ও ঋণ খেলাপি হওয়ার কারণে সরাসরি কাঁচামাল আমদানী করতে পারছি না। বাধ্য হয়ে অন্যের সাহায্য নিয়ে কমার্শিয়াল লাইসেন্সের মাধ্যমে কাঁচামাল আমদানীকালে ৫% অগ্রিম ভ্যাট (এটিভি) দিয়ে থাকি। এতে আমার কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে; যা ফেরত পাচ্ছি না। এতে সরকার লাভবান হচ্ছে। এই বৈষম্যের কারণে রুগ্ন শিল্প আরো রুগ্ন হচ্ছে। এতে আমরা বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছি না। আমি কাস্টম কর্মকর্তাদের অনুরোধ করে বলি, আপনাদের পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষ এখন আমার ডকুমেণ্টগুলো ফেরত দিয়ে দেন। তখন তারা এই অফিস থেকে সেই অফিস, এক অফিসার থেকে অন্য অফিসার এভাবে আমাকে অহেতুক ঘুরাতে থাকেন। টঙ্গী বিভাগের এসি আব্দুল হান্নান বলেন, কমিশনার অফিসে আপনার জব্দকৃত মালামাল আছে। ২/৩ দিনের মধ্যে মামলা হবে। তার পর জব্দকৃত মালামাল ফেরত পাবেন। কিন্তু মামলা হচ্ছে না, আবার মালামালও ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। অপরদিকে গত ১৫ এপ্রিল একটি কাল্পনিক দাবী ধার্য করে ১৫ দিনের মধ্যে এর জবাব চাওয়া হয়। এর আগে গত ১৮ মার্চ মালামাল ফেরত নেওয়ার জন্য টঙ্গী বিভাগের সহকারী কমিশনার (এসি) বরাবরে লিখিত আবেদন জানাই। কিন্তু জব্দকৃত মালামাল এখনো ফেরত দেওয়া হয় নাই। এ অবস্থায় গত ২৭ এপ্রিল নোটিশের জবাবে আমরা জানাই, আমাদের দলিলাদি ও প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র জব্দ করে নিয়ে যায় আপনাদের অফিসে, আমাদের হাতে কিছুই অবশিষ্ট নাই। শুধুমাত্র স্মৃতি দিয়ে জবাব দেওয়া সম্ভব নয়। আমাদের জব্দকৃত মালামাল ফেরত দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা ও নোটিশের জবাব দেওয়ার সুযোগ দানের অনুরোধ জানাই। তথাপি অদ্যাবধি কাগজপত্র ফেরত না দিয়ে আমাদের প্রতি মারমুখী আচরণ করেন ঢাকা উত্তর বিভাগের ডেপুটি কমিশনার শরফুদ্দিন মিয়া। এভাবে আমাদেরকে ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে। আমাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জব্দ করে নিয়ে যাওয়ায় আমরা কোন পার্টির কাছে কত টাকা পাই সেটাও আমরা বলতে পারছি না, এবং আমাদের কাছে কোন পার্টি কত টাকা পায় সেটাও জানতে পারছি না। এতে আমরা আর্থিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। পাওনাদারদের দ্বারা আমরা লাঞ্চিত হচ্ছি। এখন ডেপুটি কমিশনার শরফুদ্দিন বলছেন, মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পরে কাগজপত্র ফেরত দেওয়া হবে। মামলার বাদীপক্ষ বা টঙ্গী বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা বলছেন, বিভাগীয় অফিসের স্যারেরা আমাদেরকে বাদী করে আপনাদের নামে মামলা করেছেন। তাদের নির্দেশে অব্যাহতিগ্রাপ্ত কোম্পানীর বিরুদ্ধে আমরা মামলা করেছি। তাদের সাথেই আপনাদের সমাধান করতে হবে।
এদিকে এব্যাপারে কাস্টমস, এক্্রাইজ ও ভ্যাট, টঙ্গী বিভাগের সহকারী কমিশনার ও বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. আব্দুল হান্নানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ব্যবসায়ী আমির হোসেনের আলোচিত প্রতিষ্ঠানে আমরা নিজেদের সিদ্ধান্তে অভিযান পরিচালনা করি নাই। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমরা তার কারখানায় পরিদর্শন বা অভিযান পরিচালনা করেছি। এখানে আমাদের কিছুই করার ছিল না। ভ্যাট অব্যাহতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানে অভিযানের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভ্যাট অব্যাহতিপ্রাপ্ত হলে পণ্যের গায়ে অমূচনীয় কালি দ্বারা মূল্য লেখা থাকার নিয়ম রয়েছে। সেখানে এই নিয়ম ভঙ্গ হয়েছে কিনা তাও তদন্ত করে দেখতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email
728×90 Banner

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here